লাদেনকে ফাঁসানো এসআইকে বাঁচাতে তৎপর ওসি!


বরিশালটুডে ডেস্ক: লাদেন ও তার বাবা মোসলেম জোমাদ্দারকে অপহরণ করা হলেও ৪০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে মঙ্গলবার বিকেলে মোসলেমকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে টাকা না পেয়ে লাদেনকে তিন পিস ইয়াবা দিয়ে এসআই রিয়াদ কাউনিয়া থানায় চালান দেন বলে অভিযোগ স্বজনদের।

পিতা-পুত্রকে ডিবি পরিচয়ে ‘অপহরণ করে’ চাঁদা দাবি এবং পরে তা না পেয়ে ছেলেকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার ঘটনায় ফুঁসছে বরিশালবাসী। এ ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) রেদোয়ান হোসেন রিয়াদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকার কাউনিয়া থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে। একেক সময় তার একেক রকম বিবৃতিতে বিভ্রান্ত সংবাদকর্মীরাও।

মঙ্গলবার সকালে জমিজমা-সংক্রান্ত একটি মামলায় হাজিরা দিতে মেহেন্দিগঞ্জের শ্রীপুর থেকে লঞ্চযোগে বরিশাল নদী বন্দরে আসেন মোসলেম জোমাদ্দার ও তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে আব্দুল্লাহ বিন লাদেন। উপবন নামের একটি লঞ্চ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই দুইজন ব্যক্তি নিজেদের ডিবি পরিচয় দিয়ে লাদেন ও তার বাবা মোসলেমকে তল্লাশি শুরু করেন। একপর্যায়ে নিচে পড়ে থাকা একটি নীল রঙের কাগজ দেখিয়ে তারা বলেন- ‘এই তো পেয়েছি’। তারা ঠিক কী পেয়েছেন, তা তারাই জানতেন। এরপর নদীবন্দর থেকে লাদেনকে মোটরসাইকেলে করে আর মোসলেমকে রিকশায় করে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়। একপর্যায়ে লাদেনকে মারধর শুরু করেন ডিবি পরিচয় দেয়া ওই দুইজন। এক লাখ টাকা না দিলে তাদের ছাড়া হবে না বলে জানান তারা। সবশেষ ৪০ হাজার টাকায় সমঝোতা করতে রাজি হন তারা।

পরে বাবা মোসলেমকে ছেড়ে দিয়ে ছেলেকে আটকে রাখা হয় এবং জানা যায় ডিবি পরিচয় দেয়া ওই দুই ব্যক্তির একজন কাউনিয়া থানার এসআই রেদোয়ান হোসেন রিয়াদ। তিনি প্রথমে তিন পিস ইয়াবা পাওয়ার দাবি করে লাদেনকে কাউনিয়া থানায় আটকে রাখেন। তবে তাকে ধরে আনা হয় কোতোয়ালী থানা এলাকা থেকে।

এ বিষয়ে শুরুতে কাউনিয়া থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘রিয়াদ (এসআই) মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়ে ৩ পিস ইয়াবাসহ ওই যুবককে আটক করেছেন- এমন খবর আমার কাছে রয়েছে। তার কাছে নাকি আরও ইয়াবা পাওয়ার কথা ছিল। অভিযান শেষ করে বিকেলে তাকে (লাদেন) থানায় রেখে যান তিনি।’ এমনকি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।

কিন্তু ওই রাতেই বদলে যায় ওসি আসাদুজ্জামানের সুর। এসআই রিয়াদের পক্ষে সাফাই গেয়ে তখন তার দাবি ছিল, এক হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছিলেন এসআই রিয়াদ। অভিযানে লাদেনকে তিন পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়েছে।

সে সময় এক থানা পুলিশ অন্য থানা এলাকায় অভিযান চালাতে পারে কি না- এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন ওসি।

পরে বুধবার দুপুরে ওসি আসাদুজ্জামান জানান, ধাওয়া দিয়ে ধরতে গিয়ে ঘটনাস্থল কোতোয়ালি মডেল থানার মধ্যে গিয়ে পড়ে। তাই নিয়মানুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মামলাটি কোতোয়ালি মডেল থানায় করা হয়েছে এবং মামলার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কাউনিয়া থানা থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখানে নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। পাশাপাশি লাদেনের বিরুদ্ধে কাউনিয়া থানার এসআই রেদওয়ান হোসেন রিয়াদও কোতোয়ালি মডেল থানায় মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেছেন।

ঘটনার সত্যতা অনুসন্ধানে মঙ্গলবার রাতেই সরেজমিনে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউনিয়া থানায় হাজির হয় সংবাদকর্মী। গারদ থেকেই লাদেনের সঙ্গে কথা হয় তাদের।

সে সময় লাদেন বলে, ‘আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়ার পথে লঞ্চঘাট থেকে আমাদের ডিবি বলে তুলে নেন এসআই রিয়াদ স্যার ও আরেকজন। পরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে বিকেলে টাকা দাবি করে আব্বাকে ছেড়ে দেন তারা। কিন্তু আমাকে ইয়াবার মামলা দিয়ে থানায় নিয়ে আসেন। আমি বিড়ি-সিগারেটও খাই না। তাহলে আমার নামে এ মিথ্যা মামলা কেন?’

লাদেনের বাবা মোসলেম জোমাদ্দার জানান, টাকা না দিতে পারলে পরে তাকে চরকাউয়া খেয়াঘাট এলাকায় নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়, কিন্তু তার ছেলের কোনো হদিস ছিল না। পরে ৯৯৯-এ ফোন করা হলে সেখান থেকে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এক পর্যায়ে তিনি জানতে পারেন, কাউনিয়া থানার এসআই রিয়াদ এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন।

এ বিষয়ে মোসলেমের দাবি, তাদেরকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হচ্ছে। বলেন, ‘ঘুরে বেড়ানোর মধ্যেই পুলিশের কর্মকর্তা এসআই রিয়াদ ১ লাখ টাকা দাবি করেন, আর সেই টাকা চেয়ে বাড়িতে স্বজনদের কাছে ফোন দিতে বাধ্য করেন। একটি বিকাশ নম্বরও দেন তিনি। পরে ৪০ হাজার টাকা ম্যানেজ করে দেয়ার শর্তে আমার ছেলেকে কাউনিয়া থানায় আটকে রেখে ছেড়ে দেন।

‘টাকা ম্যানেজ করতে না পেরে রাতে থানায় গিয়ে পুলিশের কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি খুলে বলি, কিন্তু তারা তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ করেননি। পরে টাকা দেয়ার জন্য এসআই রিয়াদের দেয়া বিকাশ নম্বরে যোগাযোগ করে জানতে পারি সেটি বরিশালের আমতলার মোড় এলাকায় অবস্থিত। এ ধরনের প্রমাণ থাকার পরও পুলিশ লাদেনকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়েছে।’

জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের যোগসাজশেই এসআই রিয়াদ এমন করে থাকতে পারেন বলে দাবি করেন মোসলেম।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, এসআই রিয়াদ চাকরির মাত্র কয়েক বছরে মেট্রোপলিটনের বেশ কয়েকটি থানা ও ডিবিতে দায়িত্ব পালন করেন। তবে অজানা কারণে কোনো জায়গাতেই দীর্ঘদিন থাকা হয়নি তার। তার বিরুদ্ধে এর আগে রোগীর দালালদের ধরে কৌশলে টাকা আদায়সহ কয়েকটি অভিযোগও রয়েছে, যদিও সেগুলো পরবর্তীতে আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সূত্র আরও জানায়, ওসি আসাদুজ্জামানের সঙ্গে এসআই রিয়াদের পূর্ব পরিচিতি আছে। কারণ ওসি আসাদুজ্জামান যখন বন্দর থানায় কর্মরত, তখন রিয়াদও ওই থানায় ছিলেন।

এদিকে লাদেনকে ফাঁসানোর বিষয়টি পরিষ্কার হতে তার স্বজনরা সিসি ক্যামেরা পর্যালোচনা করার দাবি তোলেন।

এ বিষয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মো. ফজলুল করিম বলেন, ‘ঘটনাস্থল কোতোয়ালি থানা এলাকায় হওয়ায় মামলাটি এখানে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই হয়েছে। তদন্তও সঠিকভাবে করা হবে।’

না জানিয়ে অন্য থানা এলাকায় অভিযান চালানো, তুলে নেয়া ব্যক্তিদের নিয়ে সারা দিন বিভিন্ন স্থানে ঘোরা, রাতে দীর্ঘ সময় এক থানায় আটকে রেখে পরে অন্য থানায় হস্তান্তর এবং দাবিকৃত টাকা না দেয়ায় ফাঁসিয়ে দেয়াসহ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। সেখানে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া কোনো পুলিশ সদস্য বা অন্য কারও ইন্ধনে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য এমনটা করছে কি না, সে বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে।’

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, ‘এসআই রিয়াদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তাতে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। যে অপরাধ করবে সেটার দায় ব্যক্তিরই নিতে হবে। রিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে পেরে ইতোমধ্যে উত্তর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনারকে পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সাইফুল ইসলাম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটলে সেই অনুযায়ী অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এক্ষেত্রে পুলিশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা আশা করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাবেক নেত্রী ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এ ধরনের প্রাকটিস কাম্য নয়। ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আর ক্ষমতার জবাবদিহিতা থাকাও দরকার। পুলিশের ক্ষমতার জবাবদিহিতা না থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’

গবেষক আনিসুর রহমান খান স্বপন এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘যে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, তাকে কেন থানাতে রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলো ভালোভাবে তদন্ত করা হয়নি অথবা আইনের কোনো ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে ওই পুলিশ সদস্য আবারও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এখানে সিস্টেমে সমস্যা রয়েছে। এইসব পুলিশ সদস্য পুলিশের ভাবমূর্তি যেভাবে নষ্ট করছে সেইভাবে সমাজেরও ক্ষতি করছে। চাকরির সামান্য কয়েক বছরের মধ্যে কয়েকটি অপকর্ম ঘটানো এই পুলিশ সদস্যকে স্থায়ী ভাবে বহিষ্কার করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ। এ ছাড়া এসব পুলিশ সদস্যকে যারা প্রশ্রয় দিয়ে পুষে রেখেছেন, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা উচিৎ।’