স্টাফ রিপোর্টার: প্রজনন মৌসুমে সাগর-নদীতে ইলিশ আহরণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে দেশজুড়ে। গত ১৩ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া নিষেধাজ্ঞার সময়কাল শেষের দিকে চলে এলেও শতভাগ ইলিশ নিধন ঠেকানো যাচ্ছে না। যার সব থেকে বড় চিত্র উঠে এসেছে বরিশাল বিভাগ জুড়ে চলমান মৎস্য বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বিগত বছরগুলোর মতো এবারেও দক্ষিণাঞ্চলের ইলিশ বিচরণের সকল নদ-নদীতে কৌশলে নিধনের প্রক্রিয়াটি চলছে। এর প্রভাব গিয়ে ভবিষ্যৎ ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় পড়ার শঙ্কা রয়েছে। আর তাই শতভাগ ইলিশ নিধন বন্ধে জনসচেতনতার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মৎস্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে আহরিত মোট ইলিশের ৬৬ ভাগ আসে বরিশাল বিভাগ থেকে। বিভাগের আওতায় বিশাল জলসীমায় সরকারি যেকোনো নির্দেশনা বাস্তবায়নে মৎস্য বিভাগকে সহায়তা নিতে হয় সরকারি অন্য দপ্তর ও সংস্থার কাছ থেকে। সেইসঙ্গে জলযান ও জনবল সংকটে সকল দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে নদীতে অভিযানেও যেতে হিমশিম খেতে হয় মৎস্য বিভাগকে। আর সংকটের সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে বিগত দিনগুলোর মতো এবারেও ইলিশ নিধন হচ্ছে একরকম নির্বিচারেই।
এছাড়া অভিযানে গিয়ে হামলার কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। যেমন হিজলা উপজেলার আওতাধীন মেঘনা নদীর অংশে অভিযানে গিয়ে ১৮ অক্টোবর রাতে হামলার শিকার হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন অভিযানিক দল। সে ঘটনায় অভিযানিক দলকে রক্ষা পেতে ১১ রাউন্ড ফাঁকা গুলিও ছুড়তে হয়।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জানিয়েছেন, প্রতিবছরের মতো এবারও অভিযানে গেলে জেলেরা বাধা দিচ্ছেন। বিশেষ করে দড়িচর-খাজুরিয়া এলাকার কালাবদর নদীতে হামলা বেশি হয়।
অপরদিকে হিজলার স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, অভিযানের পরও নদী অনেকটাই জেলেদের দখলে। দুর্গম চরগুলোতে রাতে ইলিশ বেচাকেনা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তবে অভিযানও যে জোরালো হচ্ছে না এমনটাও নয়, গত ২৮ অক্টোবর ভোরে হিজলার বাউশিয়া সংলগ্ন মেঘনার শাখা নদীতে শুধু অভিযানিক দলে ভয়ে জাল ফেলে পালাতে গিয়ে নয়ন ব্যাপারী (৬২) নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে।
যদিও অভিযোগ রয়েছে মৎস্য বিভাগের নির্ধারিত মাঝিরাই অভিযানের তথ্য দিয়ে দিচ্ছে অসাধু জেলে চক্রকে। ফলে অভিযানে নামার পূর্বেই বেশিরভাগ তথ্য চলে যাচ্ছে অসাধুদের কাছে। এতে অভিযানিক দল যেদিকে এগিয়ে যায়, তার ঠিক উলটো দিকে ইলিশ নিধনের কাজ চলে।
মেঘনা তীরের বাসিন্দা লোকমান হোসাইন বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারেও নদীতে চোর-পুলিশ খেলা চলছে। অভিযানিক দল এলে অসাধু জেলেরা ছোট ছোট খাল বা চরের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অভিযানিক দল চলে গেলে আবার মাছ শিকার শুরু করেন জেলেরা।
হিজলার বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, এবার অসাধু জেলেরা কৌশল বদলেছেন। তারা এবার নদীতে এমনভাবে জাল ফেলে যে বোঝার উপায় নেই, কারণ কৌশলগতভাবে জালগুলো পানির নিচে তলিয়ে দেয়া হয় এবং কোনো ধরনের চিহ্ন না থাকায় তা বোঝা যায় না। অভিযানিক দল এসেও নদীতে সবকিছু স্বাভাবিক দেখতে পেয়ে চলে যায়। তবে অসাধু জেলেরা জাল ফেলে নির্ধারিত সময় বাদে গিয়ে নৌকার গ্রাফি দিয়ে সেগুলো টেনে তুলে। আর এভাবে প্রতিটি জালেই ইলিশ ধরা পড়ছে। এদিকে গোপনে প্রতিদিন নদী তীরবর্তী এলাকায় ইলিশ বেচাবিক্রিও হচ্ছে।
বরিশাল সদরের সাহেবের হাটের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, মঙ্গলবার সকালে ৩টিতে এককেজি হয় এমন সাইজের ইলিশ লাহারহাট নদী তীরে বিক্রি হয়েছে ৫ শত টাকা কেজি দরে। তবে ভিন্নতা রয়েছে বরিশাল শহরে।
শহরতলীর তালতলী থেকে বাসায় ১ হাজার ৩৫০ টাকা কেজি দরে এক কেজি সাইজের ইলিশ পৌঁছে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন আলেকান্দা এলাকার বাসিন্দা সাব্বির।
তিনি বলেন, তালতলী-শায়েস্তাবাদ এলাকায় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন বহু জেলে মাছ ধরে সেই মাছ বরিশাল শহরের বিভিন্ন এলাকায় নির্ধারিত লোকেরা বিক্রি করেন। যারা ১ হাজার ৩৫০ টাকা কেজিদরে এক কেজি সাইজের ইলিশ বাসায় পৌঁছে দেয়। আর কেজিতে ৪টি ইলিশ এমন সাইজের মাছ বাসায় পৌঁছে দিলে দাম পড়ে সাড়ে ৫ থেকে ৬ শত টাকা। তবে নদী তীরে গিয়ে মাছ কিনলে দাম অনেকটাই কমে যায় বলে জানান তিনি। এভাবে গ্রাম ও শহরে মাছ বিক্রির কথা স্বীকার করছেন মেহেন্দিগঞ্জের শ্রীপুর ইউনিয়নের নিবন্ধিত জেলেরাও।
তারা বলেন, নিবন্ধিত হয়ে এখন শুধু নিষেধাজ্ঞার সময় নদী তীরে বসে দেখি মাছ কাটা, কালাবদর, তেতুলিয়ায় কীভাবে ইলিশ নিধন করছে চক্র। আবার প্রশাসনের স্পিডবোটের শব্দ পেলে কীভাবে তারা মুহূর্তেই তীরে চলে যাচ্ছে।
বানারীপাড়ার বাসিন্দা সবুজ বলেন, সন্ধ্যা নদীতে কিছু জেলেদের বিভিন্ন সময় মাছ নিধন করতে দেখা যায়। তবে অভিযানিক দল সেসব জায়গাতে যাওয়ার আগেই তারা কীভাবে বুঝতে পারে জানি না। তারা আসার পূর্বে সবাই তীরে উঠে যায়, ফলে অভিযানিক দল এসে সবকিছু স্বাভাবিক দেখতে পায়।
তার মতে, অসাধু সিন্ডিকেটের কাছে অভিযানের তথ্য না থাকলে এটা সম্ভব নয়।
আর নদীতে যে অবাধে ইলিশ নিধন হচ্ছে না এটা অস্বীকার করার সুযোগও নেই মৎস্য বিভাগের। কারণ, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের অভিযানে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে জাল নদী থেকে উদ্ধার হচ্ছে, ইলিশ নিধনে যাওয়া অসাধু জেলেরা আটক হয়ে জেল-জরিমানা সম্মুখীন হচ্ছেন এমনকি প্রচুর ইলিশও জব্দ হচ্ছে।
মৎস্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ ধরার অপরাধে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদীতে অভিযান চালিয়ে ৫১৭ জেলেকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ২৪ লাখ ১ হাজার ৬শত টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। সেইসঙ্গে এই ১৭ দিনের অভিযানে ১৫ হাজার ৮২৪ কেজি ইলিশ জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৬ কোটি ৫২ লাখ ৯৪ হাজার ১শত টাকা মূল্যের ৮৮ লাখ ৬৫ হাজার ৮ শত মিটার অবৈধ জাল জব্দ করা হয়েছে।
যদিও যে পরিমাণ ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ার জন্য আসে তার মধ্য খুব কমই ধরা পড়ছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস।
তিনি বলেন, কঠোর অভিযান ও নজরদারির কারণে ধীর ধীরে নিষেধাজ্ঞার সময় নদীতে ইলিশ আহরণ কমেছে। এ কারণে প্রচুর ইলিশ এসময়টাতে নিরাপদে ডিম ছাড়তে পারে, সেইসঙ্গে একটা ইলিশ এত পরিমাণে ডিম ছাড়ে তাতে সবমিলিয়ে ভবিষ্যৎ সংকটের কোনো সুযোগ থাকে না।
মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের মতে শত শত জেলের বিরুদ্ধে মামলা ও সাজা দিয়ে ইলিশ নিধন বন্ধ করা যাবে না। জনসচেতনতাই একমাত্র ভরসা।
তিনি বলেন, মৎস্য অধিদপ্তর মূলত সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। জেলেদের মধ্যে ভীতি তৈরির জন্য দেওয়া হয় মামলা ও সাজা।