বরিশালটুডে ডেস্ক: বাজারে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্প্রতি তিন দফায় ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অনুমতি পাওয়ার এক মাসে একটি ডিমও আমদানি হয়নি। ফলে দাম তো কমেইনি, উল্টো বেড়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৮ সেপ্টেম্বর চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়। এর পরপরও পর্যায়ক্রমে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।
কিন্তু শর্তপূরণ ও অতিরিক্ত কর, পূজার ছুটিসহ নানা রকম জটিলতায় ডিম আমদানি করে লাভের মুখ দেখার আশা কম। তাই তারা আমদানিতে ঢিলেমি শুরু করেছে।
এদিকে, বাংলাদেশের আমদানির খবরে ইতোমধ্যেই ভারতে ডিমের দাম বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। আর ডিমের ওপর ৩৩ শতাংশ শুল্ক থাকায় দেশের বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি করা নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ফলে চিন্তাভাবনা করেই ডিম আমদানি করবেন আমদানিকারকরা। সব মিলিয়ে এক মাস আগে ডিম, আলু ও পেঁয়াজ নিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। আলু ও পেঁয়াজের বেঁধে দেওয়া দাম মানেননি ব্যবসায়ীরা। এখন ডিম আমদানিতেও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর চার প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ২১ সেপ্টেম্বর আরও ছয় প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় হয়।
তৃতীয় দফায় গত ৮ অক্টোবর আরও পাঁচ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। গত ২ অক্টোবর থেকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমদানি অনুমতিপত্র দিচ্ছে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর।
আমদানিকারকরা বলছেন, গত ২ অক্টোবর আমদানিকারকদের আইপি দেওয়া হয়েছে। এখন এলসি খুলে ডিম আমদানি করতে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে সংকট হয়েছে অন্য জায়গায়। বাংলাদেশের আমদানির খবরে ভারতে ডিমের দাম বেড়ে গেছে।
তারা বলছেন, বর্তমানে ভারতে প্রতিটি ডিমের দাম এখন ৫ দশমিক ৭০ রুপির আশেপাশে। আমদানির অনুমতি পাওয়ার আগে ছিল ৪ দশমিক ৮০-৪ দশমিক ৯০ রুপি করে। আর ডিম আমদানিতে যে এইচএস কোডটি ঠিক করা হয়েছে, সেটিতে শুল্ক–করের হার ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য আমদানিতে ৩৩ টাকা রাজস্ব আয় হবে সরকারের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতের বাজারে ডিমের যে দাম, তাতে বাংলাদেশে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিটিতে দুই টাকার মতো রাজস্ব পাবে সরকার। সেই হিসাবে প্রতিটি ডিম বাংলাদেশে আসতে খরচ পড়বে কমপক্ষে সাড়ে ১০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা যে হিসাব দিচ্ছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, আমদানি করা ডিমের দাম কম পড়ছে না। এতে বাজারে খুব বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম; বরং সরকারের রাজস্ব আয় বেশি হবে।
ডিম আমদানিতে শর্তপূরণ নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুমুক্ত দেশ থেকে ডিম আমদানি করার কথা বলা হয়েছিল। সেই সনদ জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমদানিকারদের।
ডিম আমদামির অনুমতি পাওয়া মীম এন্টারপ্রাইজের মালিক ইয়ার হোসেন বলেন, গত ২ অক্টোবর আমরা আমদানির অনুমতিপত্র (আইপি) পেয়েছি। আমরা ভারত থেকে ডিম আমদানি করব। কিন্তু সেখান আমদানির শর্তপূরণ সংক্রান্ত নথিপত্র পেতে দেরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, আরও কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাই এখনো ডিম আমদানি করা যায়নি। ডিম আমদানিতে শুল্ক–করের হার ধরা হয়েছে ৩৩ শতাংশের মতো। এত শুল্ক–কর দিয়ে ডিম এনে মূলধন টেকানো যাবে কি না, সেটি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে।
একদিন পরই দুর্গাপূজার ছুটি শুরু হবে। তখন স্থলবন্দরে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। কলকাতার ব্যবসায়ীরাও উৎসবে ব্যস্ত থাকবেন। তাই বলা যায় শিগগিরই ডিম আমদানি হচ্ছে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ডিম আমদানির অনুমতিপত্র (আইপি) পেয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। আশা করছি শিগগিরই আমদানি করা ডিম বাজারে আসবে। তখন দাম কিছুটা কমবে।
বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নতুন করে ডিমের বাজারে অস্থিরতা। শেষ এক সপ্তাহে প্রতি হালি ডিমের দাম পাঁচ টাকা বেড়ে ৫৫ থেকে ৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বড় বাজার থেকে কিনলে ডিমের ডজন পড়ছে ১৬০ টাকা, আর পাড়া-মহল্লার খুচরা দোকানে ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের একটি ডিম খেতে গুনতে হচ্ছে ১৪ টাকা। অথচ সরকার প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে বাজারে ডিমের দাম বেড়েছে। যখন দাম বেঁধে দেওয়া হয়, তখন বাজারে প্রতি হালি ডিমের দাম ৫০ থেকে ৫৩ টাকার মধ্যে ছিল, যা এখন ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৫০ পয়সা হলে খুচরা বাজারে তা ১২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। সেই হিসাবেও এক হালি ডিমের দাম হয় ৪৮ টাকা। কিন্তু বাজারে তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
ডিমের বাজারে কারসাজির মাধ্যমে অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করায় ছয় কোম্পানি ও চার বাণিজ্যিক অ্যাসোসিয়েশনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর করতে শুরু থেকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় সারা দেশে গড়ে একশর মতো প্রতিষ্ঠান জরিমানা গুনছে বেশি দামে এসব পণ্য বিক্রি করায়। এ ছাড়া ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসব নানামুখী তৎপরতার পরও এই এক মাসে বাজারে পণ্যটির দাম কমেনি, বরং বেড়েছে।
গত আগস্টে এক ডজন ডিমের দাম ১৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় ‘সিন্ডিকেটের’ মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণকে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো প্রতিটি ডিমের মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়।
এরপর তিন দফায় ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অনুমতির এক মাস পার হলেও এ পর্যন্ত আমদানির কোনো ডিম দেশে আসেনি। দর বেঁধে দেওয়ার এক মাস পরও বাজারে তা কার্যকর করা যায়নি। খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ টাকায়।
বেঁধে দেওয়া এ দর যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় প্রথম দফায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর চার প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- মীম এন্টারপ্রাইজ, প্রাইম এনার্জি ইমপোর্টার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স, টাইগার ট্রেডিং ও অর্ণব ট্রেডিং লিমিটেড।
দ্বিতীয় দফায় ২১ সেপ্টেম্বর আরও ছয় প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- চিজ গ্যালারি, পপুলার ট্রেড সিন্ডিকেট, এমএস রিপা এন্টারপ্রাইজ, এসএম করপোরেশন, বিডিএস করপোরেশন ও মেসার্স জয়নুর ট্রেডার্স। দুই দফায় মোট দশ প্রতিষ্ঠানকে ১০ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।
এরপর তৃতীয় দফায় গত ৮ অক্টোবর আরও পাঁচ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: ইউনিয়ন ভেনচার লিমিটেড, জে এফ জে প্যারাডাইস কানেকশন, লায়েক এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স লাকি এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স পিংকি ট্রেডার্স।
যেসব শর্তে ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার, সেগুলো হলো- এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুমুক্ত দেশ থেকে ডিম আমদানি করতে হবে। আমদানিকৃত ডিমের প্রতিটি চালানের জন্য রপ্তানিকারক দেশের সরকারের মাধ্যমে নির্ধারিত কিংবা ক্ষমতাপ্রাপ্ত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দেওয়া এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুর ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ামুক্ত সনদ দাখিল করতে হবে। সরকার নির্ধারিত শুল্ক বা কর পরিশোধ করতে হবে। নিষিদ্ধ পণ্য আমদানি করা যাবে না। সরকারের অন্য বিধিবিধান মেনে চলতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিদিন ডিমের চাহিদা চার কোটি পিস। দেশের খামারিরা বলছেন করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বেড়ে যাওয়া ফিডের দামের প্রভাবে অনেক খামারি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। এ কারণে ডিমের উৎপাদন পৌনে তিন কোটিতে নেমেছে। অন্যদিকে মাছ, মাংস, সবজির দাম চড়া হওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে ডিমের ওপর।